বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন বন্যা কবলিত এলাকা গুলোতে বিশুদ্ধ পানির অনেক সংকট রয়েছে। পানির বিশুদ্ধতা আমাদের সুস্বাস্থ্য ও সুরক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দূষিত পানি পান করলে বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি থাকে, যেমন ডায়রিয়া, কলেরা, টাইফয়েড ইত্যাদি। পানি বিশুদ্ধ করার বিভিন্ন উপায় রয়েছে, যার মাধ্যমে আমরা সুরক্ষিত পানি পেতে পারি। নিচে পানি বিশুদ্ধ করার কয়েকটি প্রধান উপায় নিয়ে আলোচনা করা হলো:
🔰 ফুটিয়ে পানি বিশুদ্ধ করা:
ফুটিয়ে পানি বিশুদ্ধ করা একটি প্রাচীন এবং প্রমাণিত পদ্ধতি। পানি ফুটানোর মাধ্যমে এতে থাকা ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও অন্যান্য জীবাণু ধ্বংস করা হয়। পানিকে কমপক্ষে ১-৩ মিনিট ধরে ফুটাতে হবে। উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে পানি ফুটানোর সময়টা কিছুটা বাড়াতে হয়। তবে, এই পদ্ধতিতে পানির সব ধরনের দূষণ দূর হয় না, যেমন ভারী ধাতু বা রাসায়নিক।
🔰 পানি ছাঁকনি (ফিল্টার) ব্যবহার:
বাজারে বিভিন্ন প্রকারের পানি ফিল্টার পাওয়া যায় যা বিভিন্ন স্তরের ছাঁকনি ব্যবস্থার মাধ্যমে পানি থেকে ময়লা, ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য দূষণ দূর করতে পারে। ফিল্টারগুলো সাধারণত সক্রিয় কার্বন, সিরামিক, বা ইউএফ (আল্ট্রাফিল্ট্রেশন) প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকে। কিছু উন্নত ফিল্টার, যেমন রিভার্স অসমোসিস (RO) ফিল্টার, ভারী ধাতু, আর্সেনিক, এবং অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদান দূর করতে সক্ষম।
🔰 ক্লোরিন বা আয়োডিন ব্যবহার:
ক্লোরিন বা আয়োডিন ব্যবহার করে পানিকে বিশুদ্ধ করা যেতে পারে। এটি মূলত ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস ধ্বংস করার জন্য ব্যবহৃত হয়। ক্লোরিন ট্যাবলেট বা দ্রবণ পানিতে মিশিয়ে নির্দিষ্ট সময় অপেক্ষা করলে জীবাণু ধ্বংস হয়। তবে, এই পদ্ধতিতে পানির গন্ধ বা স্বাদ পরিবর্তন হতে পারে এবং কিছু লোকের কাছে এই স্বাদ গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে।
🔰 আল্ট্রাভায়োলেট (UV) আলো:
আল্ট্রাভায়োলেট (UV) আলো দিয়ে পানি বিশুদ্ধ করা বর্তমান যুগের একটি উন্নত পদ্ধতি। ইউভি আলো পানির জীবাণু, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এবং অন্যান্য ক্ষতিকর জীবাণুকে ধ্বংস করে, যা পানিকে নিরাপদ করে তোলে। ইউভি পদ্ধতিতে কোনো রাসায়নিক ব্যবহার করা হয় না এবং পানির স্বাদ বা গন্ধ পরিবর্তন হয় না। তবে, এটি শুধু জীবাণু ধ্বংস করতে সক্ষম, তবে পানি যদি কোনোরূপ রাসায়নিক দূষণে আক্রান্ত হয়, সেটি এই পদ্ধতিতে দূর হয় না।
🔰 সোলার ডিসইনফেকশন (SODIS):
সোলার ডিসইনফেকশন একটি সহজ এবং কম খরচে পানি বিশুদ্ধ করার পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে প্লাস্টিকের বোতলে পানি ভরে সরাসরি সূর্যের আলোতে রেখে দেওয়া হয়। সূর্যের আল্ট্রাভায়োলেট (UV-A) রশ্মি পানির জীবাণু ধ্বংস করতে সাহায্য করে। সাধারণত, এই পদ্ধতিতে ৬-৮ ঘণ্টা সময় প্রয়োজন। তবে, পানি যদি খুব ময়লা বা ঘোলা হয়, তবে এই পদ্ধতি কার্যকরী নাও হতে পারে।
🔰 বালি এবং গ্রাভেল ফিল্টার:
বালি এবং গ্রাভেল (পাথরের কণা) ফিল্টার একটি প্রাচীন এবং কার্যকরী পদ্ধতি। এতে পানি বালির ওপর দিয়ে ধীরে ধীরে ছেঁকে নিচে পড়ে এবং ময়লা, কাদা, এবং বড় জীবাণু আটকে যায়। তবে, এটি মাইক্রোবায়োলজিক্যাল দূষণ সম্পূর্ণরূপে দূর করতে পারে না, তাই অন্যান্য পদ্ধতির সঙ্গে মিলে ব্যবহার করা উত্তম।
🔰 রিভার্স অসমোসিস (RO):
রিভার্স অসমোসিস (RO) একটি অত্যন্ত কার্যকরী পদ্ধতি যেখানে পানিকে উচ্চ চাপের মাধ্যমে আধা পারমিবল মেমব্রেন দিয়ে ছাঁকা হয়। এটি পানিতে থাকা ক্ষতিকর রাসায়নিক, ভারী ধাতু, আর্সেনিক, এবং লবণ দূর করে। RO ফিল্টার সাধারণত উন্নত পানির ফিল্টার সিস্টেম হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যা নোনা পানি এবং আর্সেনিক দূষণ দূর করতে বিশেষভাবে কার্যকর।
🔰 রাসায়নিক সমাধান (Chemical চয়াগুলাতিওন):
রাসায়নিক সমাধান একটি জটিল কিন্তু কার্যকর পদ্ধতি। এতে রাসায়নিক পদার্থ যেমন অ্যালুমিনিয়াম সালফেট (ফিটকিরি) বা আয়রন ক্লোরাইড ব্যবহার করে পানির কঠিন উপাদানকে একত্রিত করে জমাট বাঁধানো হয়, যা পরে ফিল্টার করা সহজ হয়। এই পদ্ধতিতে ক্ষুদ্র কণা এবং জীবাণু সহজেই অপসারণ করা যায়।
📌মনে রাখবেন:
পানি বিশুদ্ধ করার পদ্ধতিগুলোর মধ্যে কিছু পদ্ধতি সহজ, সাশ্রয়ী, এবং কম খরচে করা সম্ভব, যেমন ফুটানো, সোলার ডিসইনফেকশন ইত্যাদি। আবার কিছু পদ্ধতি অত্যাধুনিক এবং কার্যকরী, যেমন RO ফিল্টার বা UV আলো। তবে, সঠিকভাবে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী পানি বিশুদ্ধ করার পদ্ধতি নির্বাচন করতে হবে, যাতে আমরা নিরাপদ পানি পান করতে পারি এবং পানিবাহিত রোগ থেকে মুক্ত থাকতে পারি।